- Advertisement -spot_img

ফ্যাসিবাদের ভাষা

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_imgspot_img

বিখ্যাত পণ্ডিত স্যামুয়েল জনশন বলেছেন ‘ভাষা হল চিন্তার পোশাক।’ সমাজকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে ভাষার ভূমিকা মুখ্য। আমাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু এদেশের রাজনীতিবিদরা বাংলা ভাষার কিছু শব্দ ও ভাষাশৈলীকে ফ্যাসিবাদে রূপ দিয়েছেন। তাই এই লেখাটির শিরোনাম ফ্যাসিবাদের ভাষা।

গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ যে ভাষায় কথা বলেন তাতে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ষ্পষ্ট। তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে ‘ক্ষমতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। রাষ্ট্র পরিচালনা কেন ‘ক্ষমতা’ হিসেবে গণ্য হবে, এ প্রশ্ন আমরা কখনো করিনি। প্রায়শই নেতারা বলেন ‘ক্ষমতাসীন দল’, ‘ক্ষমতায় আছি’, ‘ক্ষমতার চেয়ার’, ‘ক্ষমতার পালাবদল’ ইত্যাদি। নেতাদের ব্যবহৃত এই শব্দমালায় পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠে ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের পার্থক্য। একই সংগে পরিলক্ষিত হয় নেতার ফ্যাসিবাদী চরিত্র, যা অতি সুক্ষ্ম, অতীব কৌশলযুক্ত। বিষয়টি সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে, যা এখন ভাববার সময়।

রাজনীতিবিদদের মুখে ‘ক্ষমতা’ শব্দটির মধ্যে একধরণের শক্তিমত্তা প্রকাশের ইঙ্গিত থাকে। নেতারা কি শক্তি প্রদর্শনের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন? তাহলে তা কোন শক্তি? সে শক্তি কি জনগণকে আরও শক্তিশালী করে? ফ্যাসিবাদী শক্তি প্রয়োগ হয় জনগণের বিরুদ্ধে, জন আকাঙ্খার বিপরীতে। নেতা যখন হীনস্বার্থে শক্তি প্রয়োগ করেন, তখন তা ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়। এবং এই চর্চায় যিনি বা যারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, মনের অগোচরেই তাদের মুখ হতে বেরিয়ে আসে ‘ক্ষমতা’ শব্দটি। ফ্যাসিস্টরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ক্ষমতা প্রয়োগ করেই সবকিছু করায়ত্ব করা সম্ভব। ইতিহাসে তাই দেখা গেছে। হিটলার থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল ফ্যাসিস্ট দম্ভ আর আত্মারম্ভিতার ভাষায় কথা বলেছেন। যার অন্যতম শব্দ ‘ক্ষমতা।’

অপরদিকে আমাদের দেশে সাধারণদের মধ্যে প্রজাসূলভ একটি বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। প্রায় দুশো বছর কিংবা তারও অধিককাল ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের পেষণে এটি হয়েছে বলে ধারণা করি। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই ধরা যাক। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষকে কথা বলতে দেয়নি। তারা বল প্রয়োগ করে বাধ্য করেছে শাসকের কথা শোনাতে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা শিখিয়েছে। যে কারণে সাধারণদের মধ্যে বল প্রয়োগকারীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে স্থানীয় বলপ্রয়োগকারী বা তথাকথিত ক্ষমতাবানের কাছে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বকে সঁপে দিতে। সেই ধারাটি আজ অবধি আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এখনও গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষ স্থানীয় ‘মাতব্বর’-এর কাছে ছুটে যান। তারা মনে করেন মাতব্বরই এলাকার ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তার কথার ওপরে কারও কোনো কথা বলার সাহস নেই। নির্বাচনের সময় এলে ওই তথাকথিত মাতব্বরের সংগে পরামর্শ করেন। কাকে ভোট দেবেন তা নির্ধারণ করে দেন তথাকথিত শক্তিমান ব্যক্তিটি। অর্থাৎ প্রজা হিসেবে থাকার মানসিকতা আমাদের সাধারণের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। সেখান থেকে আজ অবধি বের হতে পারিনি।

ফ্যাসিবাদী নেতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের দলকে ‘আমাদের দল’ বলে একপ্রকার শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটায়। নেতাদের কিছু বক্তব্যে ব্যবহৃত ‘আমাদের’ শব্দটি সমষ্টিক হতে বিচ্ছিন্ন এবং একক হয়ে ওঠে যা তারা কখনো অনুধাবন করেন না অথবা অনুধাবন করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছেন। দেশে দলগুলোর মধ্যে ব্যক্তির প্রাধান্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। সে কারণে দলের প্রভাবশালী নেতার আচরণ দলীয় কর্মীদের প্রভাবিত করছে। খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগে একজন মন্ত্রী (বর্তমানে সাবেক) হজ্জ্ব পালন শেষে দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন মাথায় টুপি পরে ঘুরতেন। এটি দেখে প্রথমেই অনুকরণ করতে শুরু করেন ওই মন্ত্রীর সচিব। কয়েকদিনের মধ্যে মন্ত্রীর লটবহরের সবার মধ্যে টুপি পরিধানের প্রবণতা শুরু হয়ে গেল। এসব নিছক চাটুকারিতা যা ফ্যাসিবাদি চরিত্রেই সম্ভব। একইভাবে নেতার ভাষায় কথা বলাও সংক্রামিত হয় দলীয় কর্মীদের মধ্যে। যার অজস্র প্রমাণ রয়েছে।

‘ঔদ্ধত্য’ ফ্যাসিবাদের ভাষার আরেকটি দিক। ফ্যাসিস্ট নেতা-কর্মীরা সাধারণত উগ্র ভাষায় কথা বলেন। এদেরকে মার্জিত ভাষা ব্যবহার করতে খুব কম দেখা যায়। কথায় কথায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ যেন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। যুক্তিবোধের তুলনায় গলা চড়িয়ে কথা বলে প্রতিপক্ষকে দমাতে এরা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিগত দিনে ঔদ্ধত্যের সবচেয়ে ভয়াল রূপ দেখতে হয়েছে দেশের টেলিভিশনের টকশো গুলোয়। ওইসব আলোচনা অনুষ্ঠানে ফ্যাসিস্ট নেতারা প্রতিপক্ষকে শুধু উগ্র কথায় জব্দ করেন নি, অনেককে শারিরীকভাবেও লাঞ্ছিত করেছেন।

বিগত দিনে নেতাদের মুখে অশালীন ভাষাও প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। আগেকার দিনের তুলনায় এখন তথ্যপ্রাপ্তির পর্যাপ্ত সুযোগ থাকায় কে, কোথায়, কখন, কী বলে, মুহুর্তেই সে খবর রটে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে দেখতে পাই নেতৃবৃন্দ কত অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। প্রতিপক্ষকে কটুক্তি এবং গালাগাল করা কোনো সভ্য সমাজ গ্রহণ করতে পারে না। প্রসঙ্গত, একজন রাজনৈতিক নেতা ‘খেলা হবে’ জাতীয় শব্দ রাজনীতির ময়দানে শুরু করেছেন। রাজনীতিতে এধরণের শব্দ প্রয়োগ কতটা প্রাসঙ্গিক বা আদৌ শোভন কি না-এই নিয়ে ওই শব্দস্রষ্টার দলের আরেক সিনিয়র নেতা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে এর প্রতিবাদ করেছেন। বিশ্বজয়ী সাহিত্যিক বরিস পাসতেরনাক বলেছিলেন-কথা যদি ‘রৌপ্য’ হয়, তাহলে নীরবতা হলো ‘সোনা’। রাজনীতিতে এসব ভাষা প্রয়োগ না করে বরং মৌনতাই শ্রেয়। ইমাম গাজ্জালি বলেছেন, মানব জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে মুখের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হওয়া। এতদিন আমরা নীরিহ জনগণ বুঝতে পারিনি ওইসব নেতার ফ্যাসিবাদী চরিত্র, যা তাদের ভাষার মধ্যেই নিহিত। কিন্তু সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাববার, কথা বলার।

বাঙালি জাতির মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। ‘নীরিহ’ এবং ‘লড়াকু।’ কথা সত্য। আমরা যেমনি কোমল তেমনি কঠিন। তবে কঠিনের তুলনায় কোমল থাকাই আমাদের পছন্দ। কিন্তু সে সৌভাগ্য খুব একটা হয় না। রাজনীতির নামে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বার বার এদেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্নকে দুমড়ে মুচরে দিয়েছে। আমারা গণতন্ত্রকামী, কিন্তু রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যার অন্যতম কারণ অপ-রাজনীতি। জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। নেতাদের দেখতে চায় সমাজসেবক হিসেবে। তাই যারা নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী, তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা তথাকথিত ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার কথা না ভেবে জনসেবার কথা ভাবুন। ফ্যাসিবাদী ভাষা পরিহার করে জনগণের মনের ভাষা পাঠ করুন।

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ
- Advertisement -spot_img
সম্পর্কিত খবর
- Advertisement -spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here