শিক্ষার্থী ও জনতার দুর্বার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পালানোর পর দলটির রাজনীতির টেকা না টেকা নিয়ে আলোচনা করছে মানুষ। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর জোহরা তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। আলোচনায় আছে যে, জোহরা তাজউদ্দিনের মানের নেতা না থাকায় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আদৌ টিকে থাকবে নাকি ভিন্ন কোন আঙ্গিকে তারা সরব হবে।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। আলোচনায় উঠে এসেছে জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের পদোন্নতিতে এই দুই দলের সমর্থিত কর্মকর্তাদের আনুকল্য পাওয়া। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। দেশজুড়েও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের সরব উপস্থিতির সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। সেই তুলনায় জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনা অনেকটা খেলার মাঠের সাইড লাইনে থাকা খেলোয়াড়দের মতো।
এদিকে পত্র-পত্রিকা মারফত এটাও জানা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের মূল দায়িত্ব হিসেবে “সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা” করার কথা বলছেন। উল্লেখ্য যে, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া যে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের দায়িত্ব লাভ সেখানেও মূল দাবীটি হলো —সংস্কার।
আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সংস্কার কার্যক্রমের কাঠিন্য বোঝাতে গিয়ে বলছেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন একদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ যে শাসন কাঠামো তৈরি করেছে সেখানে ক্ষমতায় টিকে থাকার সাধারণ সূত্রানুযায়ী যা যা করার সবটাই তারা অনুসরণ করেছে। যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কাঠামোগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে ভেঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে সরকারি সকল দপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিকতার সাধারণ কাঠামো অনুসরণ না করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার সংস্কার সহজ কোন কাজ নয়। এলক্ষ্যে সিস্টেমের ক্ষতিগুলোকে বিশদভাবে পর্যালোচনা করা ও গভীরভাবে উপলব্ধিতে নিয়ে সংস্কারের রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু ১৮ কোটি লোকের এই দেশ তো বসে থাকবে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবন একটা চলমান বিষয়। প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকতার ক্ষতিগুলো নিরূপণ করা এবং সিস্টেম সংস্কার করার দূরূহ কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এটা বলা যাবে না যে, দেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে বসে থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ৪০ দিনের রাষ্ট্রপরিচালনায় একটা কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে যে, তাদের কাজের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার উপর। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা উপদেষ্টাবৃন্দ যেমন বলছেন তেমনি জনগণও বলছে। এমনকি এই মুহুর্তের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টিও বলছে। অন্যান্য ছোটখাটো দলগুলোও এই কথা বলা থেকে বিরত থাকছে না।
বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশ একটা অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে চলছিল। আওয়ামী লীগ কোথায় কী করতে পারে সেটার একটা ধারণা মানুষের তৈরি হয়েছিল। যে যার জায়গা থেকে সেই অবস্থার সাথে মিলিয়ে নিয়েছিল। ৫ আগস্টের পর মানুষের মধ্যে নতুন করে “স্বাধীন” হওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। এবং বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ সামনে আগানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রত্যাশার চাপ যে শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রয়েছে তা নয়, একইসঙ্গে বিএনপি, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও রয়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা প্রশ্নে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে নারী ও মেয়ে শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জনগণ জানতে চায়।
গত কয়েকদিনে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন অংশে নারী ও মেয়ে শিশুরা হেনস্তার শিকার হয়েছে। কলকারখানা বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিক নারীরা তাদের পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পথেঘাটে নারীদের মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতনের অনেক ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। শিক্ষার্থী জনতার গণআন্দোলনে সবাই দেখেছে যে, আন্দোলনের সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে নারী ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা। ফলে, নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার যে বিপুল প্রত্যাশা তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সেখানে নারী ও মেয়ে শিশুদের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে সেখানে এসে অনেকেরই জিজ্ঞাসা —আগামীর দিনে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে সেই রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাদের বক্তব্য কী।
আমি মনে করি যে, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটা বড় সুযোগ। তারা এই মুহুর্তেই পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের নারী ও মেয়েশিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাদের নীতি ঘোষণা করতে পারে। যদি এ নিয়ে তাদের পৃথক কোন নীতি না থাকে তাহলে সেটা তৈরি করারও এটি ভালো সময়। কারণ যে নতুন বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে সেখানে আগামীতে যে নির্বাচন হবে তখন প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের নীতি ঘোষণার পাশাপাশি তারা কীভাবে তাদের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়ন করবেন সেই কর্মপন্থা ঘোষণা করতে হবে।
কারণ নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার পূর্ব শর্ত হলো নিরাপদ নারী ও শিশু। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের দেশের বাল্য বিয়ের মূল সমস্যা নারী শিশুদের নিরাপত্তার অভাব। আমাদের দেশে গত দশ বছরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া কিশোর গ্যাং কালচারের মূল ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা। এই দেশে একজন নারী এবং মেয়ে শিশু একাকী রাতে চলতে পারে না। এমনকি দিনের বেলায়ও একা কোথাও যেতে ভয় পায়! কোথায় এসব দূর করা হবে তা না করে এখন শারীরিক ও মানসিক আক্রমণ ও নির্যাতনের সাথে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে “মোরাল পুলিশিং” বা নিজের নৈতিকতা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া ও “মব জাস্টিজ” বা প্রকাশ্যে উচ্ছৃংখল মানুষদের আদালত।
এই দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় নারী ও শিশুদের প্রাধান্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যাবতীয় প্রতিজ্ঞা ও তার বাস্তবায়ন দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল করবে। কারণ নারীরা ভালো থাকলে আমাদের পরিবারগুলো ভালো থাকবে। আর সমাজে নারীদের সরব উপস্থিতি সমাজকে আরো বেশি সহনশীল ও একতাবদ্ধ করবে। ফলে বিশ্বে আমাদের সুনাম বাড়বে। আমাদের পাসপোর্ট শক্তিশালী হবে। এবং সেই সুবাদের আমরা আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারব। একটি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানো জাতি হিসেবে বিশ্বে আমাদের মর্যাদা বাড়বে। এখন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর যে, তারা জনগণের চাওয়ার সাথে মিলিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াবে নাকি জনবিচ্ছিন্ন থাকবে।